শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৩

পরিজন


অপরিচিত, তবু দেখা হয়েছিল

জুলাই 20, 2013

ওয়ালিউর রশীদ তমাল

dhakareport24.com

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এ কথা বলতে কোন তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন হয় না। যারা হুমায়ূন আহমেদের কোন ভালো লেখা খুঁজে পাননি তাদের জন্য হুমায়ূন আহমেদের ২০/৫০ টি অসাধারন বইয়ের নাম লিখে দেয়ার মতো লাখো পাঠক আছে, যে কেউ লিখে দিতে পারবে। সুতরাং সে কথা থাক। আমার বিশ্বাস, তারা দেখেও দেখেন না অথবা 'অর্ধেক খালি গ্লাস' দেখতে পছন্দ করেন বেশি, ভরা অংশ তাদের চোখে পড়ে না।
একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের লেখার অংশবিশেষ তুলে দিয়ে বলা হতো ‘শুদ্ধ করিয়া লিখ’ কিন্তু যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন তাদের মুখে 'কলুপ' এঁটেছিল। সেই কলুপ খুলতে আজ পর্যন্ত কেউ সাহস পায়নি।
আমাদের দেশেও নিদ্রামগ্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী (যারা জীবনব্যাপী অন্যের নিন্দা-মন্দে জাতিকে বিভক্ত-বিচ্ছিন্ন করতে শশব্যস্ত) বুদ্ধিজীবীর কোনো অভাব নেই। তারা অন্যের প্রাপ্য কেড়ে নিতে, অন্যের বাড়া-ভাতে ছাই দিতে উন্মুখ। তারা ‘সিটি অফ মোসাহেব’ কিংবা ‘কিংডম অফ চাটুকার’ এর রাজকবি, বুদ্ধিজীবী। তাই মানুষের নিন্দা করে কাউকে আনন্দ করতে দেখলে এখন আর বিস্মিত হই না। মানুষ তো 'মানুষ' হত্যা করেও উল্লাস করে। আমি তাদের দলে নই।
তাদের বলছি, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের পরে হুমায়ূন আহমেদের নাম করলে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হয় না। তিনি ১০০টিরও বেশী ছোট গল্প লিখেছেন। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো  হুমায়ূন আহমেদের কোন গল্পটি খারাপ?
যারা হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে ভালো কিছু খুঁজে পাননি তাদের জন্য আরো উদ্ধৃত করছি: সৈয়দ শামসুল হকের লেখা নিবন্ধ 'হৃদকলমের টানে' তে হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প ‘চোখ’ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: “বস্তুত হুমায়ূন তাঁর প্রতিভাবান কলমে এমন এক পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে এবং বাধ্য করে নতুন করে সংজ্ঞা নির্ণয় করতে যে,  কাকে বলে নৃশংসতা, আর কাকেই বা বলে বিচার এবং কী'ইবা আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি। যেখানে আমরা সকলেই কি ভীষণ ও ভয়াবহ রকমে উদাসীন জীবন ও মানবিকতা সম্পর্কে। কোনো রকম মন্তব্য না করে, মিথ্যে আবেগে আপ্লুত না হয়ে, হুমায়ূন আহমেদ এই যে গল্পটি লিখেছেন, এই একটি গল্পেই তীব্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এ কোন দেশ ও কালে আমরা বাস করছি। আমি মনে করি সাম্প্রতিককালের বহু ছোটগল্পের ভেতরে এটি একটি প্রধান রচনা এবং বারবার পঠিত হবার মতো লেখা।”
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বদলে দেয়া এই মানুষটি আমার কেউ না, না আত্মীয়, না সুহৃদ, না শিক্ষক, কিছুই না। তবু কি দুর্বার আকর্ষণ তাঁকে ঘিরে, যার শুরুটা সেই স্কুল লাইফের শুরুর দিক থেকে।
আমার ছোটবোন (লাবণ্য, কম্পিউটার সায়েন্স, চুয়েট) এর ব্যাক্তিগত লাইব্রেরিতে বোধহয় হুমায়ূন আহমেদের এমন কোন বই নেই। আমার 'হুমায়ূন আহমেদ' পড়া শুরু আমার বোন কে দেখে। তারপর অন্য দশটা বাঙালি ছেলের মতো 'হুমায়ূন প্রেমী' হয়ে যাওয়া।
তারপর একদিন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এলাম ঢাকায়, ভর্তি হলাম নটরডেম কলেজে। তখন আমার প্রথম একুশে বইমেলায় যাওয়া। সেদিন ঘোরাঘুরি করছি, হুট করে বন্ধু তারেক পেছন থেকে শার্টের কলার খামচে ধরে বলল, "দেখ, সামনে কে?"
অবাক হয়ে শুধু দেখলাম, দুই হাত সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন ঋজু ভঙ্গিতে। একটা 'সালাম' দেয়ার কথাও মাথায় আসেনি উত্তেজনায়। শুধু দেখলাম। আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দেখে তারেক টেনে নিয়ে এলো।
এরপর আরেকবার অবশ্য দেখা হয়েছিল, কথাও বলেছিলাম। কুমিল্লায় 'জাতীয় বিতর্ক উৎসব' আয়োজন করছিলাম তখন আমরা। আমাদের মিডিয়া পার্টনার ছিলো এটিএন বাংলা। তো এটিএন এর অফিসে সরকার ফিরোজ আহমেদ স্যারের রুমে একদিন কি কাজে যেন ঢুকলাম। ঢুকেই 'থ'। স্যারের সামনের চেয়ারে হুমায়ূন আহমেদ বসা। মুখ দিয়ে শুধু 'স্লামালাইকুম' বের হলো আস্তে করে, আর কিছু না। কি নিয়ে যেন কথা বলছিলেন, শেষ করে ফিরোজ স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে উনার ভাতিজা বলে। হুমায়ূন আহমেদ হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, কি করি, কোথায় পড়ি। উচ্চারণের 'ত্রুটি'র কারনে কিনা জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি কই? কুমিল্লায় শুনে জিজ্ঞেস করলেন, ঠাকুরপাড়া চিনি কিনা। একটা সময় থেকেছিলেন উনি সেখানে। কথার ফাঁকে ফাঁকে আসা তাঁর ফোনগুলো বিরক্ত করছিল তাঁকে। হুট করে নওয়াজেশ আলী খান স্যার এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন।  হোক না চার-পাঁচ মিনিটের পরিচয়, তবু দেখা তো হলো।
আমি ধন্য হলাম।


লেখক : গীতিকার ও সুরকার